জাতিসংঘে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শক্তিশালী বার্তা: পরিবর্তনের পথে বাংলাদেশের যাত্রা


জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল নিউইয়র্কেছবি: রয়টার্স


জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে শুক্রবার ভাষণ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে তিনি বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে রাষ্ট্রকাঠামোর আমূল সংস্কারের সুযোগ এবং টেকসই গণতন্ত্র, সুশাসন ও সমৃদ্ধির ভিত্তিতে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠনের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেন। 


ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে বিশ্ব সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান বাংলাদেশের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপসমূহ এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের দায়িত্বগুলির কথা। ড. ইউনূস ভবিষ্যতের পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলিও তুলে ধরেন।


শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ তাঁর বক্তব্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বাংলাদেশের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। 


শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষণে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণ এবং বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেন। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থাপন করেন এবং তাদের সহযোগিতার আহ্বান জানান। ড. ইউনূস বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, যা ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বাংলাদেশের ভূমিকা তুলে ধরেছে।


বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ টেনে ড. ইউনূস বলেন, "জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনই আমাকে আজ এই মহান সংসদে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। আমাদের তরুণ সমাজ ও সাধারণ মানুষের অদম্য শক্তি রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।" 


তিনি আরও বলেন, প্রথমে ছাত্র ও যুবসমাজের আন্দোলন ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে, যা পরবর্তীতে একটি ব্যাপক গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। পুরো পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে কীভাবে বাংলাদেশের জনগণ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ড. ইউনূস উল্লেখ করেন, "ছাত্র-জনতার দৃঢ় সংকল্প এবং ঐক্যের মাধ্যমে আমরা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। এটাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ—একটি দায়িত্বশীল ও সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে বিশ্বের মাঝে প্রতিষ্ঠা লাভ।"


ড. ইউনূস বলেন, "এই গণ-আন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের সুবিধাবঞ্চিত জনগণকে একত্রিত করেছে, যারা একটি ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। তরুণ প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছে, মায়েরা এবং শ্রমিকেরা রাজপথে সন্তানদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। আমরা এই স্বৈরাচারী শক্তির হাতে ৮০০ এর বেশি মানুষের জীবন হারিয়েছি, তবে আমাদের এই সংগ্রামই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের ভিত্তি।


ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং অর্থনীতি সুসংহত করার তাগিদ দেন, যেখানে বিশ্বের প্রতিটি দেশ কার্বনমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে। এ প্রেক্ষাপটে তিনি 'তিন শূন্য' ধারণার প্রস্তাব দেন, যা শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে। 


তিনি বলেন, এর মাধ্যমে পৃথিবীর তরুণ-তরুণীরা চাকরির সন্ধানী না হয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাবে। তারা সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে ব্যবসার মাধ্যমে সামাজিক সুফল, অর্থনৈতিক মুনাফা এবং প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তারা ভোগবাদী জীবনধারা থেকে বেরিয়ে এসে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য এক নতুন শক্তি হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে।


ড. ইউনূস আরও বলেন, এই সময়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ এবং একতা প্রয়োজন। জাতিসংঘ, সরকারসমূহ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এই লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের অভিযোজনের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগের আহ্বানও জানান তিনি।


রোহিঙ্গা সংকট: বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ঝুঁকি


রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার ফলে সৃষ্ট হলেও বাংলাদেশ এবং এ অঞ্চলের জন্য এটি নিরাপত্তা ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি রোহিঙ্গাদের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং তাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্বও তুলে ধরেন।


মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি: ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতির আহ্বান


মধ্যপ্রাচ্য প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান গণহত্যা কেবল আরব বা মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য উদ্বেগের। তিনি ফিলিস্তিনে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন, যা মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে সক্ষম হবে। 


ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক প্রভাব


ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কেও ড. ইউনূস আলোচনা করেন, যা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তিনি উভয় পক্ষকে সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ নিরসন করে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান।


জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারত্বের ৫০ বছর


ড. ইউনূস জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ বৈশ্বিক শান্তি, ন্যায়, মানবাধিকার এবং সমৃদ্ধিতে ধারাবাহিকভাবে অবদান রেখেছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post