গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয়ে যাওয়া কৃষক মো. আক্তারুজ্জামান এবং নাগরিক সনদ নিতে গিয়েছিলেন নাজিম উদ্দিন—দুজনেই সেবা নিতে না পেরে ফিরে গেছেন। তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, ইউপি চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতি। তরগাঁও ইউনিয়নে বর্তমানে কোনও চেয়ারম্যান নেই, কারণ তিনি পলাতক। এখানে, প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এস এম ফাতেমা, যিনি সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। তবে তিনি ইউপি অফিসে এসে সেবা দিতে সময় পাচ্ছেন না, কারণ স্কুল পরিদর্শনসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত। এই অবস্থা শুধু তরগাঁও ইউনিয়নেই নয়, বরং গাজীপুরের অন্য ইউনিয়নগুলোতেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
**ইউপি চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতি**
৫ আগস্টের পর থেকে, বিশেষ করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর, অনেক ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে, কেউ গ্রেপ্তার এড়াতে বা হামলা থেকে বাঁচতে আত্মগোপন করেছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ৫ আগস্টের পর থেকে সারা দেশে ১,৪১৬ ইউপি চেয়ারম্যান তাদের কার্যালয়ে অনুপস্থিত, যা মোট ইউনিয়ন পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ। এসব চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতি এবং পলাতক অবস্থায় জনগণকে নাগরিক সেবা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
**এ ধরনের সমস্যার বিস্তার**
এই পরিস্থিতি শুধু গাজীপুরেই নয়, দেশের অন্যান্য জেলার কিছু ইউনিয়নেও বিদ্যমান। যেমন, নোয়াখালী, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, ফেনী—এখানেও অনেক ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক। এসব ইউনিয়নে নাগরিক সেবা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ ইউপি চেয়ারম্যানরা গ্রামে সরকারের বিভিন্ন সেবা যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, জন্মনিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদ এবং চারিত্রিক সনদ বিতরণ করেন। এছাড়া গ্রামে রাস্তা নির্মাণ, সংস্কার, সালিসি সিদ্ধান্তসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ইউপি পরিষদ পরিচালনা করে। কিন্তু চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত থাকলে এসব কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
**ইউপি চেয়ারম্যানদের অপসারণের চিন্তা**
গুরুতর এই পরিস্থিতি সমাধানে, সরকার ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের ৪ হাজার ৫৮০টি ইউনিয়ন পরিষদে বর্তমানে ৩ হাজার ১৬৪ জন চেয়ারম্যান অফিস করছেন। তবে প্রায় এক তৃতীয়াংশ চেয়ারম্যানই কার্যালয়ে অনুপস্থিত। তাদের অপসারণ করা হলে, নতুন প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে, যা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ প্রশাসকের দায়িত্বে আসা কর্মকর্তাদের কাছে তাদের নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে, তারা দীর্ঘ মেয়াদে ইউপি পরিচালনা করতে পারবেন না।
**নাগরিক সেবা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা**
এতে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, চেয়ারম্যানদের অপসারণের ফলে ইউপি পরিষদ ভেঙে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা স্থানীয় নাগরিক সেবায় বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনবে। সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান এবং বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, ইউপি চেয়ারম্যানদের সরিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দিলে সেবা ব্যাহত হবে। তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন, প্যানেল চেয়ারম্যান ব্যবস্থার মাধ্যমে ইউপি পরিচালনা করা উচিত, যেখানে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে একজন দায়িত্ব নেবে।
**স্থানীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপট**
বিগত স্থানীয় নির্বাচনের পর, অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না, এবং অনেক জায়গায় একতরফা নির্বাচন হয়েছে। এই পরিস্থিতির কারণে বিরোধী দল এবং জনগণের মাঝে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। তাদের মতে, এসব নির্বাচনের ফলাফল স্বচ্ছ ছিল না, তাই চেয়ারম্যানদের অপসারণ করার দাবি উঠেছে। এই বিতর্কিত নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তবে অপসারণের প্রশ্নে সরকারের দোটানার মধ্যেও বিশ্লেষকরা পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, প্যানেল চেয়ারম্যান বা স্থানীয় কাউন্সিলরের মাধ্যমে ইউপি পরিচালনা করা হবে।
**ইউপি পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ**
বর্তমানে, যেখানে ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক, সেখানে প্রশাসক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। প্রশাসক হিসেবে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা যেমন ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) বা এসি ল্যান্ড (অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, ভূমি) দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে ৭৮৬টি ইউনিয়ন পরিষদে প্যানেল চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং ৪০টি ইউনিয়নে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। তবে, প্রশাসকরা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দিতে পারবেন না, কারণ তাঁদের একাধিক দায়িত্ব রয়েছে এবং স্থানীয় জনগণের সাথে তাদের সংযোগ সীমিত।
**সম্ভাব্য সমাধান: প্যানেল চেয়ারম্যান**
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দেওয়ার চেয়ে প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে ইউপি পরিচালনা করা অনেক বেশি কার্যকর হবে। যেহেতু প্যানেল চেয়ারম্যানেরা নির্বাচিত, তারা জনগণের প্রতি বেশি দায়িত্বশীল এবং স্থানীয় পর্যায়ের সেবায় তাদের অংশগ্রহণও বেশি। এই পদ্ধতিতে সেবা ব্যবস্থার স্থবিরতা কমবে এবং জনগণের আস্থাও ফিরবে।
**ইউপি চেয়ারম্যানদের দাবি**
এদিকে, বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, চেয়ারম্যানদের অপসারণের ফলে গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। তারা দাবি করছে, নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের অপসারণ না করা উচিত। এরা বলছেন, চেয়ারম্যান না থাকলে গ্রামে চুরি, ডাকাতি বেড়ে যাবে এবং সেবা কার্যক্রম পুরোপুরি থেমে যাবে।
**শেষ কথা**
এ পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে: চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতি বা অপসারণের ফলে কিভাবে নাগরিক সেবার ব্যবস্থা বজায় রাখা যাবে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা যে প্যানেল চেয়ারম্যান ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করছেন, তা বেশ কার্যকর হতে পারে, কিন্তু সরকার যদি প্রশাসক নিয়োগের দিকে চলে যায়, তাহলে স্থানীয় সেবা গুরুতরভাবে ব্যাহত হতে পারে।