সম্প্রতি সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কমিশন গঠন করেছে এবং আরও কিছু বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন ও পর্যালোচনা চলছে। এর পাশাপাশি, শিক্ষা খাতের বিভিন্ন অংশে নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। শিক্ষার উন্নয়ন, নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন, ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখার জন্য যে সকল পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো খণ্ডিত এবং সময়ের চাহিদার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে অসংগতিপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
শিক্ষার বর্তমান সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ
শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের অপশাসন, বিনিয়োগের অভাব, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহির অভাবে এই খাতটি ক্রমশ সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য ছিল সব শিশুর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অভিন্ন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন এবং অবকাঠামো ও শিক্ষার মান উন্নয়ন। কিন্তু দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও, এই নীতির বাস্তবায়নে কোনো সমন্বিত প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ শিক্ষা-দারিদ্র্যের মধ্যে আবদ্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তর শেষ করার পরও মৌলিক সাক্ষরতা ও গণিতের দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না, যা দেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষার মানের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা
২০২২ সালে নতুন বিদ্যালয় শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে বড় পরিবর্তনের উদ্যোগও নেওয়া হয়। তবে এটি ছিল খণ্ডিত এবং শিক্ষকদের প্রস্তুতি বা বিদ্যালয়ের সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়, যা শিক্ষার গুণগত উন্নয়নে অন্তরায়।
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্য উদ্যোগ
শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যকর সংস্কার আনতে হলে, ন্যূনতম সংস্কার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পাশাপাশি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এক্ষেত্রে নিচের কিছু পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে:
1. নতুন স্বাভাবিকের সূচনা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহিষ্ণুতা, এবং শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ বিঘ্নকারী চর্চা বন্ধ করতে সংলাপের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে।
2. গ্রহণযোগ্য নিয়োগ নীতি নির্ধারণ: নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার মান ও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষায় যোগ্যতাকে একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অস্থায়ী পদায়ন না করে স্থায়ী ও কার্যকর নিয়োগ পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি।
3. নির্বাচিত ছাত্র সংসদ: সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সঠিক প্রতিনিধিত্ব পায় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতৃত্ব দিতে শেখে।
4. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পেশাদারিত্ব: শিক্ষকদের নতুনভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। সেরা মেধাবীদের শিক্ষাক্ষেত্রে আকৃষ্ট করা ও ধরে রাখার জন্য দশসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত।
মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ
শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কিছু মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন:
1. শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের ধারাবাহিক উন্নয়ন: শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক উন্নয়ন, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা এবং গুণগত মানোন্নয়ন একটি ধারাবাহিক গবেষণানির্ভর প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে হবে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের প্রসারে নতুনভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন।
2. শিক্ষার অর্থায়ন বৃদ্ধি: রাষ্ট্রীয় শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এই বিনিয়োগ বাস্তবায়ন করা জরুরি, যাতে শিক্ষার মান উন্নত হয় এবং শিক্ষার্থীদের সঠিক পরিবেশ প্রদান করা যায়।
3. শিক্ষা প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ: শিক্ষাব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে প্রশাসনিক কাঠামো বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি জেলার জন্য জেলা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে, যা স্থানীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে।
4. বৃত্তিমূলক ও কর্মমুখী শিক্ষা: শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা তৈরি, এবং বেকারত্ব হ্রাসে ব্যবসায়িক খাতের সহযোগিতায় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রসারের বড় উদ্যোগ নিতে হবে।
সফল সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার
শিক্ষা খাতে সংস্কার কার্যকর করতে হলে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। অতীতে অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে। সফল সংস্কারের জন্য প্রয়োজন শিক্ষাবিশেষজ্ঞ, তরুণ প্রজন্ম, এবং অংশীজনদের নিয়ে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা, যা সংস্কারের কৌশল, প্রক্রিয়া, এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবে।
এভাবে একসাথে কাজ করলে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুদৃঢ় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।