গত তিন দশকে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। আশির দশকে দেশে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, যার মধ্যে চারটি সাধারণ ও দুটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়। নব্বইয়ের দশকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় সরকারি ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের স্থান সংকুলান করা যাচ্ছিল না, যার ফলে তারা বিদেশে পড়তে যাচ্ছিলেন। এই প্রবণতা অভিভাবকদের জন্য ব্যয়বহুল ছিল এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার উপরও চাপ তৈরি করছিল। এ সময় উদ্যোক্তারা বিষয়টিকে ব্যবসার সম্ভাবনা হিসেবে দেখেন, আর সরকারও বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে। ফলে দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এরপর একের পর এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন এলাকার এমপিরা তাদের এলাকায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তদবির করতে শুরু করেন। এর ফলে দেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৩টি। এছাড়া তিনটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১০ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
তবে, সমস্যার দিকটি হলো, গত ৩০ বছরে আমাদের দেশে এত বেশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। দেশে এখনো এত শিক্ষার্থী বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসেনি যে, তারা এই চাহিদা পূরণ করতে পারবে। পাশাপাশি, বেশির ভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিছু নির্দিষ্ট ব্যবসাকেন্দ্রিক কোর্সের উপর নির্ভরশীল, যেমন কম্পিউটার সায়েন্স ও বিবিএ। এর ফলে এসব বিষয়ে শিক্ষকের চাহিদা অনেক বেশি, কিন্তু যোগ্য শিক্ষকের অভাব প্রকট। ফলে কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক দিয়ে পড়ানো হচ্ছে, যা শিক্ষার মান কমিয়ে দিচ্ছে। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার মান উন্নত নয়। শিক্ষকের যোগ্যতা এবং পাঠদানে অনীহা থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে।
শিক্ষকদের যোগ্যতার ঘাটতি ছাড়াও, নিয়োগ প্রক্রিয়ার সমস্যাও রয়েছে। মেয়েদের জন্য এসএসসি এবং পুরুষ প্রার্থীদের জন্য এইচএসসি বা বিএ যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা মানের ঘাটতি তৈরি করেছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার অভাবে অনেক শিক্ষক জাতীয়করণ পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন, যার ফলে তাদের মধ্যে মান ও দায়িত্ববোধের অভাব রয়েছে। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে শিক্ষকরা প্রায়ই আন্দোলনে নামছেন, যা শিক্ষাদানে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। পাশাপাশি, মাধ্যমিক শিক্ষায়ও একই ধরনের সমস্যা বিদ্যমান। মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবে অনেক স্কুল শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ ঢাকায় কেন্দ্রীভূত, এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে যেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী বা শিক্ষক নেই। অনেক ক্ষেত্রে এর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। এর প্রেক্ষিতে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় অংশকে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে কারিগরি শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা উচিত। উচ্চশিক্ষা সকলের জন্য নয়, বরং এটি মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত হওয়া উচিত যারা গবেষণা ও নীতিনির্ধারণে অবদান রাখতে পারে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষা কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো শনাক্ত করে তা সমাধানের পথ নির্ধারণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।