সূত্র : প্রথম আলোর মতামত কলাম
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড. ইউনূস তাঁর সরকারের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের অবস্থান কী, তা অনেকটাই পরিষ্কার করতে পেরেছেন। এই সরকার প্রচলিত অর্থে ‘রাজনৈতিক’ নয়, তবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও সরকারের পতনের মাধ্যমে এই অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসেছে। এ কারণেই এটি জনগণের ইচ্ছার সরকার হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো এই সরকারের প্রতি আস্থা ও সমর্থন জানিয়েছে, তবু সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মূলত রাজনৈতিক বিষয়গুলোই সামনে এসেছে।
সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পতিত শক্তির পুনরুত্থান ঠেকানো এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর গণআকাঙ্ক্ষা পূরণ। এর মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর আস্থা অর্জন, রাজনৈতিক সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন, এবং স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে জড়িত শক্তিগুলোর সমর্থন ধরে রাখা ছিল বড় লক্ষ্য। এই সব ‘রাজনৈতিক’ দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারকে কঠোর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে এ সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে বলে এটিকে জনগণের ইচ্ছার সরকার হিসেবে ধরা হয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সরকার ইতিমধ্যে সফলভাবে সমর্থন আদায় করতে পেরেছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড. ইউনূস স্পষ্ট করেছেন যে, বিশ্বসম্প্রদায় বর্তমান সরকারকে সমর্থন করছে। অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতিও মিলেছে, যা সরকারের ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করেছে। যে ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারেনি, তারা ধীরে ধীরে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে হাঁটবে বলে মনে হচ্ছে।
স্বৈরাচারী সরকারের পতন ছিল রক্তাক্ত এবং দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ফল। শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর কয়েকদিন দেশ কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সেসময় দেশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ বাহিনীর কার্যকারিতা শূন্যের কোঠায় ছিল, এবং প্রশাসন ছিল স্বৈরাচারী সরকারের অনুগত কর্মকর্তা দ্বারা পূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতেই বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। সেই সুযোগে বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সক্রিয় হয়, যা এখনো চলছে। ছাত্র-জনতা যাদের রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যেও মতবিরোধ ও বৈপরীত্য রয়েছে। এসব পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কাজটি সরকারের জন্য সহজ ছিল না।
সরকারের উপদেষ্টারা বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্নভাবে কথা বলছেন, যার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কখনো কখনো হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা বাতিল করার ঘটনাও ঘটছে, যা জনগণের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সরকারের শক্তিশালী ও একক নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করা জরুরি, কারণ বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপগুলো সরকারের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলছে।
এইচএসসি পরীক্ষার বাকি অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তও সরকারের দুর্বলতার একটি উদাহরণ। কিছু শিক্ষার্থী সচিবালয়ে ঢুকে পরীক্ষা বাতিলের জন্য চাপ দিলে তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়। একই ধরনের ঘটনা পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটির ক্ষেত্রেও ঘটেছে, যেখানে দুজন সদস্যের বিরুদ্ধে আপত্তি উঠলে পুরো কমিটি বাতিল করা হয়। এসব ঘটনা সরকারের ভিতরে একধরনের সিদ্ধান্তহীনতা এবং চাপের মুখে নতি স্বীকারের ইঙ্গিত দেয়।
মাজার ও দরগায় হামলার মতো ঘটনাগুলোও সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান নিতে না পারায়, এসব ঘটনায় সরকারের ক্ষমতার অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সরকারে নানা গোষ্ঠীর চাপ এবং জনগণের চাওয়া-পাওয়ার ভারসাম্য বজায় রাখার কাজ অত্যন্ত কঠিন। অনেক চাওয়ার মধ্যে স্বাভাবিক বৈপরীত্য থাকলেও, একটি ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করে সরকারকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।