বহুদলীয় গণতন্ত্রে দলীয়করণ: ‘মহাপাপ’

  


বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারণা হলো জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন করার একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়া, যেখানে সরকার পরিচালনার জন্য নির্দলীয় প্রশাসন অপরিহার্য। এটি নিশ্চিত করে যে ভোট গ্রহণ, ফলাফল ঘোষণা এবং সরকার গঠনে কোনও দলীয় পক্ষপাতিত্ব না ঘটে। নির্দলীয় পোলিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, রিটার্নিং অফিসার এবং নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সঠিক এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া গড়ে তোলা যায়।


 নির্দলীয় পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা


জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য নির্দলীয় মানুষের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। দলীয়করণের ফলে সমাজে বিভক্তি দেখা দেয়, যা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। নির্দলীয় মানুষ তৈরি করতে হলে প্রথমে প্রয়োজন নির্দলীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি দলীয় রাজনীতির প্রভাব থাকে, তাহলে ছাত্রদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটবে না। শিক্ষক ও ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে রাখার মাধ্যমে একটি স্বাধীন চিন্তার পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।


 পেশাজীবীদের ভূমিকা


প্রশ্ন উঠতে পারে, দলীয় রাজনীতি করবে কারা? ছাত্র ও শিক্ষক বাদে অন্যান্য পেশাজীবীরা ব্যক্তি হিসেবে যেকোনো দলের সদস্য হতে পারেন। তবে পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাহী পদের সদস্যদের দলীয় রাজনীতি করা উচিত নয়। কারণ, দলীয়করণের ফলে তারা ন্যায্য পেশাস্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে। এই পেশাজীবীদের উচিত নিজেদের কাজের প্রতি নিষ্ঠা রাখা এবং নিজেদের পেশাগত স্বার্থে সোচ্চার থাকা।


 সিভিল সমাজের গুরুত্ব


সিভিল সমাজ দেশের একটি শক্তিশালী নির্দলীয় ভিত্তি গড়ে তোলে এবং জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে। গত ১৫ বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ফলে সিভিল সমাজকে প্রায় অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন রোধ করা, যা দেশের জন্য একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।


 দলীয়করণের উদাহরণ


দলীয়করণ কতটা ক্ষতিকর, তার উদাহরণ পাওয়া যায় রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ভেনেজুয়েলা, বেলারুশ এবং উত্তর কোরিয়ায়। এই দেশগুলোতে গণতন্ত্রের অভাব রয়েছে এবং দলীয়করণ জনগণের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে। ইউরোপ এবং আমেরিকার গণতান্ত্রিক দেশে দলীয় ছাত্ররাজনীতি এবং পেশাজীবীদের দলীয়করণের অনুপস্থিতি এই অঞ্চলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক।


 গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া


বহুদলীয় গণতন্ত্রে এক দলের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার কোনও সুযোগ নেই। ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক হস্তান্তর একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এই প্রক্রিয়া ঘটে নির্দলীয় সিভিল সমাজের ব্যবস্থাপনায়। যদি এই প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে জনগণকে দলে প্রবেশ করানোর পরিবর্তে যদি তাদেরকে মুক্ত বাতাসে নির্দলীয় রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে গণতন্ত্রের অগ্রগতির পথ বাধাগ্রস্ত হবে না। বরং এতে স্বাধীনচেতা নেতাদের জন্ম হবে, যারা নতুন নতুন চিন্তাধারার মাধ্যমে রাজনীতিতে অবদান রাখতে পারবেন।

 নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব


নেতার পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে নেতৃত্ব নেওয়া সম্ভব নয়; বরং সঠিক দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করতে হবে। প্রশাসনে পুরনো ধারার প্রতিনিধিত্বকারী ডিসি এবং কমিশনার দিয়ে কতদিন কার্যক্রম চলবে? জনগণের ভোটে কেন নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি, জেলা পরিষদ এবং বিভাগীয় পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছে না?


 পদোন্নতি ও নিয়োগ


রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ ও পদোন্নতি কেন দলের প্রধানমন্ত্রীর হাতে? কেন পেশাজীবীরা প্রধানমন্ত্রীর চামচা হয়ে থাকতে বাধ্য হন? পেশাভিত্তিক উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠিত হলে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোর মালিকানা পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। ডিজিটাল বা সাইবার নিরাপত্তা আইন তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা কেন সৃষ্টি হবে?


অতএব, দেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহত করতে হলে নির্দলীয় রাজনীতি ও প্রশাসনের প্রতি আমাদের গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। সংবিধানে পেশাভিত্তিক উচ্চকক্ষের বিধান রাখতে আমাদের আপত্তি কেন? এটি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার একটি মাধ্যম হতে পারে

Post a Comment

Previous Post Next Post