লেখক: ড. নুসরাতে আজীজ অধ্যাপক, আলগমা ইউনিভার্সিটি, কানাডা
১৪ অক্টোবর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ড্যারন আসেমোগলু, সিন জনসন ও জেমস এ রবিনসন। তাঁদের গবেষণার মূল বিষয় ছিল ‘প্রতিষ্ঠান কীভাবে গঠিত হয় এবং তা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কীভাবে ভূমিকা রাখে’। এখানে ‘প্রতিষ্ঠান’ বলতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে বোঝানো হয়েছে, যেমন আইনশৃঙ্খলা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, বাক্স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে জাপানি প্রতিষ্ঠান নিহন হিদানকায়ো, যারা পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে রয়েছেন হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমার হামলা থেকে বেঁচে ফেরা সাক্ষীরা, যারা বিশ্বকে পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করছেন। তবে, তাদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পারমাণবিক কর্মসূচির বিস্তার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
এদিকে, অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীরা দেখিয়েছেন যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোই একটি দেশের সাফল্য বা ব্যর্থতার মূল কারণ। তবে তাঁদের উপনিবেশ ও প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বিতর্ক দেখা দিয়েছে। নোবেল কমিটি বলছে, ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তবে ইতিহাসের আলোকে এ দাবি কতটা যৌক্তিক, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
ড্যারন আসেমোগলু, সিন জনসন ও জেমস এ রবিনসনকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার প্রধান কারণ তাঁদের গবেষণা, যা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এবং তার মাধ্যমে একটি দেশের সমৃদ্ধির বিষয়ে আলোকপাত করে। তাঁরা মূলত দুটি ধরনের প্রতিষ্ঠান—অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) ও নিষ্কাশনমূলক (extractive) অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর গবেষণা করেছেন।
অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান: এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখানকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো এমনভাবে গড়ে ওঠে যে, সাধারণ মানুষও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে। এর ফলে একটি দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়। এই ধরনের প্রতিষ্ঠান কাজের সুযোগ তৈরি করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বাধীন মতামতের সুযোগ দেয়।
নিষ্কাশনমূলক প্রতিষ্ঠান: এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সাধারণ জনগণকে বঞ্চিত করে, বিশেষত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেবল একশ্রেণির মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এর ফলে সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটে, যা দীর্ঘমেয়াদে সমগ্র দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়। সাধারণ মানুষ এই প্রতিষ্ঠানের দ্বারা বঞ্চিত হয় এবং দেশের আর্থিক উন্নতি ব্যাহত হয়।
নোবেল বিজয়ীরা তাঁদের গবেষণায় আরও দেখিয়েছেন যে ঔপনিবেশিকতা ও উন্নত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। তাঁরা বলেন, যেসব দেশে ঔপনিবেশিক শক্তি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গঠন করেছে, সেসব দেশে টেকসই উন্নয়ন ঘটেছে। অন্যদিকে, যেসব দেশ উপনিবেশের সময়ে এমন প্রতিষ্ঠান পায়নি, সেসব দেশ পরবর্তী সময়ে দরিদ্র অবস্থায় রয়ে গেছে।
বিতর্কের বিষয়: নোবেল কমিটির এই বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষত, ঔপনিবেশিক শক্তি আসলে উন্নত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছিল কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঔপনিবেশিক দেশগুলো মূলত নিজেদের স্বার্থে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল, যা তাদের সম্পদ আহরণ ও ক্ষমতা বিস্তারের লক্ষ্যকে সহায়তা করেছিল। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধুমাত্র সম্পদ নিষ্কাশনের জন্য গড়ে উঠেছিল, যা উপনিবেশিত দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখেনি।
উপনিবেশের প্রভাবের উদাহরণ: নোবেল বিজয়ীরা উপনিবেশের প্রভাব বোঝাতে স্প্যানিশ উপনিবেশ আমেরিকা ও মেক্সিকোর উদাহরণ দিয়েছেন। তাঁদের মতে, কম উন্নত অঞ্চলে স্প্যানিশরা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল, যা পরবর্তী সময়ে ওই অঞ্চলগুলোকে সমৃদ্ধ করেছে। অপরদিকে, বেশি উন্নত অঞ্চলে উপনিবেশকারীরা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়তে পারেনি, যার ফলে তারা দরিদ্রই থেকে গেছে। তবে এই বিশ্লেষণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কারণ অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন উপনিবেশ স্থাপনের সময় ঔপনিবেশিক শক্তির লক্ষ্য শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশের উদাহরণও একই রকম। ব্রিটিশ শাসনের সময় কলকাতা, দিল্লি বা ঢাকা শহরের উন্নয়নে ব্রিটিশদের তথাকথিত অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেনি। এর পরিবর্তে, উপনিবেশ-পরবর্তী দেশের নিজস্ব নীতিই এ অঞ্চলের উন্নয়ন বা অবনতির জন্য দায়ী।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: নোবেল বিজয়ীদের গবেষণার আলোকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এখানে ক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে কেন্দ্রীভূত, যা নিষ্কাশনমূলক প্রতিষ্ঠানের একটি উদাহরণ। দেশের টেকসই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের, যেখানে সব শ্রেণির মানুষ সমানভাবে সুযোগ পাবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকজনই সমাজের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে, যা টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
উপসংহার: নোবেল বিজয়ীদের গবেষণা মূলত একটি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা তুলে ধরেছে এবং তা কীভাবে দেশের টেকসই উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। তবে, ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, তাঁদের কাজ বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।