চাষের মাছ, যেমন রুই ও কাতলা কেনা থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ, খাবার ও যাবতীয় খরচের পর প্রতি কেজি ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু ইলিশ মাছ, যা শুধু জেলেদের ধরা থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর মধ্যে কোনো বাড়তি খরচ নেই, তার দাম প্রতি কেজি ১,৫০০ থেকে ১,৮০০ টাকা! ইলিশ ঘাস বা খড় খায় না, খইল-ভুসি বা ফিডও খায় না, এবং ইলিশ পালনের জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে না। তাহলে দাম এত বেশি কেন?
পুকুরে ইলিশ চাষ বা টিনজাত করে বিক্রি করার সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা হয়েছে, কিন্তু তাও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া ইলিশের দাম চড়া হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তবে দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হলো বাজারে তদারকি সংস্থার দুর্বলতা, যা শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সৃষ্টি করেছে। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন, দূষণ ও বাঁধ-সেতুর মতো অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা প্রজননে হুমকি সৃষ্টি করছে। ফলে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং চাহিদার তুলনায় জোগানও হ্রাস পাচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তর প্রতিবছর ইলিশ উৎপাদনের পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে, যা ২০০২-০৩ সালে দুই লাখ টনের কম ছিল, কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ লাখ ৭১ হাজার টনে পৌঁছেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সময়সীমায় জনসংখ্যা কি দ্বিগুণ হয়েছে? জনসংখ্যা ও ইলিশ উৎপাদনের তুলনায় মাথাপিছু সরবরাহ বাড়ার কথা। তবে ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও সম্পদ বৈষম্যের কারণে ইলিশ এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
ভারতে ইলিশ রপ্তানির অজুহাতে দাম বাড়ানোর কথা বলছে কেউ কেউ। তবে বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, তা মোট উৎপাদনের মাত্র ০.২৯ শতাংশ। প্রশ্ন হলো, এতে কি দেশি ভোক্তাদের জন্য কোনো ক্ষতি হয়েছে?
ইলিশের দামে সমস্যা নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। যেমন, চড়া দামে বিক্রি হওয়া ইলিশের কত টাকা জেলেদের পকেটে যাচ্ছে? জাতীয় মাছ বিক্রিতে লাভবান হচ্ছে কারা? নদীতে ইলিশের আকাল কেন? কেন ইলিশ বছরের কোনো একটি সময়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে আসে না?
এগুলো থেকে স্পষ্ট হয়, মহাজন, ব্যাপারী, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ভূমিকা ইলিশের দামে প্রভাব ফেলে। নদী বা সমুদ্র থেকে মাছ ধরে ঘাটে আনার পর মাছের নিয়ন্ত্রণ আর জেলেদের হাতে থাকে না। সরাসরি চলে যায় মহাজনের কাছে। মহাজনের নিয়োজিত কর্মীরা প্রাথমিকভাবে দাম নির্ধারণ করে ডাক তোলেন, এরপর ব্যাপারীরা মাছ কিনে নেন।
বিদেশে এলসি হলেও আড়তদারেরা এখান থেকে মাছ কেনেন এবং স্থানীয় বাজারে এখানকার মাছ বিক্রি হয়। এরপর বিভিন্ন পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠানো হয়। মহাজন থেকে শুরু করে ক্রেতা পর্যন্ত প্রত্যেকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লাভ করে থাকেন।
এদিকে, ট্রলার মালিকদের তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হয় জাল, ট্রলার মেরামত ও অন্যান্য খরচের জন্য। তবে যদি জেলেরা পর্যাপ্ত ইলিশ না পান, তাহলে ট্রলার মালিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। ফলে ট্রলার মালিকরা অনেক সময় দাদন নিয়ে থাকেন।
দেশে ইলিশের দাম কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু এই অভিযান কি দাম কমাতে পারবে?
বর্তমানে বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশ ১,৮০০ থেকে ২,০০০ টাকায় বিক্রি হলেও ভারতে ১,২০০ টাকায় রপ্তানি হচ্ছে। এতে সমালোচনা হচ্ছে, এবং ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, প্রকৃতপক্ষে সেই দামে ভারতে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে না।
সুতরাং, দাম কমানোর জন্য প্রয়োজন চোরাচালান রোধ করা, সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া এবং জেলেদের যাবতীয় খরচ কমানো। প্রশাসন যদি ঘাট নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয় এবং জেলেদের সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে, তবে ইলিশের দাম নাগালের মধ্যে আসবে।