অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতিমধ্যেই সংস্কারের পথে এগিয়েছে। এ লক্ষ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে কাজ করা দুটি কমিশনের ওপর থাকবে বেশি নজর। কারণ, অতীতে সরকারগুলো এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ওপর নিজেদের স্বার্থে অত্যাচার চালিয়েছে, যা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি ব্যাহত করেছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু সংস্কার ছাড়া নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়।
নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা
'কী প্রয়োজন' জানার আগে 'কেন প্রয়োজন' তা বোঝা জরুরি। সঠিকভাবে সমস্যা চিহ্নিত করতে পারলে সমাধানের পথও সহজ হয়। অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশে সমস্যার মূল হলো ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অগণতান্ত্রিকতা’। স্বাধীনতার পর যারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করেছে, তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের চাহিদার বাইরে পরিচালনা করেছে। ১৯৭৩ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রবর্তন করা হয়।
পরবর্তীতে পঁচাত্তরের ঘটনা এবং সামরিক শাসনেও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছিল। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে কিছুটা ভারসাম্য ছিল। এই দশককে অনেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে সোনালি সময় বলে থাকেন, যদিও তাতে কিছু কলঙ্ক ছিল। তবে নতুন শতাব্দীতে কোনো নির্বাচনেই সেই ক্ষমতার ভারসাম্য দেখা যায়নি। ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে তুলেছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার: সংখ্যাগরিষ্ঠ বনাম বৃহদাংশ
বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থায় ‘ফার্স্ট-পাস-দ্য-পোস্ট’ (এফপিটিপি) পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, যেখানে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী প্রার্থী বিজয়ী হন। তবে, বৃহদাংশের ভোটের প্রতিফলন এতে দেখা যায় না, যা গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই ‘বহু বিজয়ী’ অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা জরুরি।
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) পদ্ধতি বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে পারে, যেখানে প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকবে। বিশ্বের বহু দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। এতে ছোট দলগুলিও প্রাপ্ত জনপ্রিয় ভোটের অনুপাতে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
দ্বিকক্ষীয় সংসদ ও প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা
পিআর ও বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও সুসংহত করতে দ্বিকক্ষীয় সংসদব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন, যেখানে উচ্চকক্ষে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এ ছাড়া, বাংলাদেশকে চার-পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করে ফেডারেল সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা
বর্তমান পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অত্যধিক, যা রাষ্ট্রপতিকে অনেকটা ‘পুতুলে’ পরিণত করেছে। তাই ক্ষমতার ভারসাম্যের স্বার্থে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায়ন জরুরি। রাষ্ট্রপতি যদি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন, তাহলে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা সহজ হবে।
সর্বোপরি, রাষ্ট্রের একটি সুষ্ঠু সাংবিধানিক কাঠামো তৈরি করতে সংবিধানের পুনর্লিখন জরুরি, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করবে।